বিশেষ প্রতিবেদনঃ- বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মূখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতনের পর পরই একের পর এক বের হয়ে আসে ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগের আমলা এমপি মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তাদের পাহাড় পরিমান দূর্নীতির খবর। সরকারের মন্ত্রীদের কার কত সম্পদ- এ নিয়ে যেমন কৌতূহল সব মহলে তেমনি সরকারী আমলাদের সম্পদ নিয়েও জানার আগ্রহ কম নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অভিযোগ উঠেছে ফেনী পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু জাফর গিফরী কোনো এক অদৃশ্য শক্তির জোরে দীর্ঘদিন যাবৎ এ পৌরসভায় কর্মরত আছেন।তার গ্রামের বাড়ী চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জে উপজেলায় ।ফেনী পৌরসভার আগে আবু জাফর দায়িত্ব পালন করেছেন চাতক পৌরসভায় । চাতক পৌরসভায় থাকাকালীন বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির কারণে তৎকালীন পৌরমেয়র শারিরীক ভাবে লাঞ্চিত করে পৌরসভা থেকে বদলী করে দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়,স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ে কোন এক আওয়ামালীগের আমলা বা মন্ত্রী’কে মোটা অংকের টাকা দিয়ে বিগত তিন বছর ধরে ফেনী পৌরসভার পাশাপাশি সোনাগাজী পৌরসভা ও পরশুরাম পৌরসভার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিভিন্ন উপর মহলে তদবির এর সুবাধে ফেনী পৌরসভায় এসে একই কায়দায় আবারও দূর্নীতি ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন আবু জাফর গিফরী।
খবর নিয়ে জানা যায়, আবু জাফর গিফারী যে পৌরসভায় দায়িত্ব পালন করেন পুরো পৌরসভা তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একক রাজত্ব্য কায়েম করেন ।আবু জাফর গিফরীর হুকুম ছাড়া চেক তো ধুরে থাক ফাইল ও নড়ে না,কমিশন না পেলে তিনি স্বাক্ষর করেন না। সুধু তাই নয় প্রতিটি পৌরসভায় অতিরিক্ত সুইপার ও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা ।
আবু জাফর গিফরী বড় গুন হলো সে যে কাউকে খুব সহজে ইমপ্রেস করতে পারে যেখানে যাবে সেখানকার মেয়রদেরকে ভুল বুঝিয়ে নিজের কব্জায় নিয়ে আসবেন পরভর্তিতে মেয়র ও তার একক রাজত্বে কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে কোণঠাসা করে রাখেন।
অনুসন্ধানে আরো উঠে আসে,গত কয়েক মাস আগে ফেনী পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজীকে ভুল বুঝিয়ে জন্ম নিবন্ধণ সংক্রান্ত বিষয়ে তিনজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে কাগজপত্র জাল জালিয়াতি ও মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ এনে ফেনী পৌরসভার সহকারী কর আদায়কারী মোঃ হুদা, স্যানেটারী পরিদর্শক পিংকু নাথ ও পিয়ন নুরনবীকে চাকুরী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। তারমধ্যে মোঃ হুদা ও পিংকু নাথ আবু জাফর গিফরীকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করান। বাকী একজন নিরীহ কর্মচারী তাকে টাকা দিতে না পারায় তার বরখাস্তের আদেশ বহাল রাখেন।
এই ভাবে সে বিভিন্ন পৌরসভায় থাকাকালীন নিরীহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের হয়রানী করতো। কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকুরী বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য সকল সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত ফাইল টাকা না দিলে স্বাক্ষর করতোনা। মন্ত্রণালয় থেকে বার বার দুই পৌরসভায় পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা পদে পদায়নের উদ্যোগ নিলে তার তদবির বানিজ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। সে যখন যে সরকার আসে নিজেকে সেই সরকারের লোক বলে দাবী করে।
তিনি ফেনী পৌরসভা থেকে প্রতি মাসে ৫- ৬ লক্ষ টাকা অবৈধ ভাবে আদায় করেন। যেখানে পৌরসভা কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা দিতে হিমসিম খাচ্ছে সেখানে প্রতি মাসে আবু জাফর গিফরী মেয়রদের সাথে মিলেমিশে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে। এখনো সোনাগাজী ও পরশুরাম পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীদের কয়েক মাসের বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে। অথচ এই দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মেয়রের সাথে মিলেমিশে প্রতিষ্ঠান গুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
অনুসন্ধানে উঠে আসে আবু জাফর গিফারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় থাকাকালীন ঘুষ ও দূর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমান অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করে ঐ পৌরসভার ১২নং ওয়ার্ডের বাদুগড় নামক স্থানে ১৬শতক জায়গা এবং কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে থাকা অবস্থায় সিটি এলাকার চাঁনপুরে একটি তিন তলা বিশিষ্ট বাড়ী করেন। তার পৈত্রিক জন্মভুমি হাজীগঞ্জে রয়েছে তার কয়েকশত জমি ও বিলাস বহুল বাড়ী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় সচিব থাকাকালীন তার বিভিন্ন অপকর্ম ও দূর্নীতির কারণে সহকর্মীরা তাকে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করলে সেখানেও তৎকালীন পৌর মেয়র তাকে বদলীর জন্য মন্ত্রনালয়কে অনুরোধ করেন।মন্ত্রনালয় তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে।কয়েক বছরের চাকুরী জীবনে মোহাম্মদ আবু জাফর গিফরী প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে নাম-বেনামে সঞ্চয়পত্র সহ নগদ টাকা।
আবু জাফর গিফরী ফেনী পৌরসভার কনজারভেঞ্চি পরিদর্শক সরোয়ার এর সাথে সম্পর্ক রেখে ব্যাটারীচালিত রিক্সা, অবৈধ সিএনজি, অবৈধ ফুটপাত ইত্যাদি থেকে প্রতিমাসে নিতেন কয়েক লক্ষ টাকা ।সরোয়ার কে পৌর মেয়র স্বপন মিয়াজী দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন অপকর্ম ও দূর্নীতির কারণে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেন। পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর গিফারী মোটা অংকের টাকা খেয়ে তাকে পূর্নবহাল করেন। এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা যতদিন এই পৌরসভায় থাকবে ততদিন চাঁদাবাজ সরওয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ইতিমধ্যে সরকার পৌরসভাগুলোতে মেয়রদের অপসারন করে প্রশাসক নিয়োগ করেছে।
ফেনী পৌরসভার বর্তমান প্রসাশক জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ফেনী এর উপ-পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন তিনি দায়িত্বগ্রহণের পর পৌরসভার নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মত পরিছন্ন কর্মীদেরও মাসিক বেতন ভাতা তোলার জন্য ব্যাংক একাউন্ট খোলার নির্দেশ দিয়েছেন। আগে এই খাতে ভূয়া নাম দেখিয়ে প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতেন পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর গিফরী ও তার দোষর সরওয়ার।
পৌরসভার হাট-বাজার বিভিন্ন ষ্ট্যান্ড ইজারার ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী ইজারাদারের কাছ থেকে দাখিলীয় দরপত্রের সম্পূর্ণ টাকা আদায় সাপেক্ষে দখল বুঝিয়ে দেওয়ার বিধান থাকলেও আবু জাফর গিফরী সুনিদিষ্ট নীতিমালার তোয়াক্কা নাকরে শাখা প্রধানের যোগশাযোশে আংশিক টাকা আদায় সাপেক্ষে ইজারাদারদের দখল বুঝিয়ে দিতো।সে দায়িত্বে থাকা প্রতিটি পৌরসভার মেয়রদের সাথে মোটা অংকের টাকা লেনদেনের মাধ্যমে একাজগুলো করত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনী পৌরসভার এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান,পৌরসভার জন্য ষ্টেশনারী মালামাল কনজারভেটিভ মালামাল বিদ্যুতের মালামাল, যাবতীয় ছাপা, কম্পিউটার ক্রয় ও সার্ভিসিং এবং বিভিন্ন সেকশানের বিল ফরম ক্রয়,দোকানপাঠ বরাদ্দ ও হস্তান্তর সহ যাবতীয় কর্মকান্ড আবু জাফর গিফরী এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এ সমস্ত খাত থেকে সে মোটা অংকের টাকা পেয়ে থাকেন। তিনি সোনাগাজী পৌরসভার হিসাব সহকারী আরমান হোসেনকে তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে সাংগঠনিক কাঠামোর বাহিরে এবং চাকুরীর বিধিমালা লংঘন করে ক্যাশিয়ার পদে পদোন্নতি দেয়। যাহা পৌরসভার চাকুরীর বিধিমালা পরিপন্থী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরশুরাম পৌরসভার আরেক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান,পরশুরাম পৌরসভার পলাতক মেয়র নিজাম উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরী সাজেল এর সকল অবৈধ ফাইল ও চেকে মোটা অংকের টাকা লেনদেন এর মাধ্যমে স্বাক্ষর করতো। প্রতি কোরবানী ঈদে সাজেল তার খামার থেকে একটি গরু বিনা পয়সায় তাকে কোরবানীর জন্য দিত। সকল পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ারদেরকে সে জিম্মি করে রাখতো এবং প্রতিনিয়ত বদলীর ভয় দেখাতো। যাহা সরেজমিনে তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে।তাই ফেনী পৌরবাসীর দাবী এই দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ফেনী পৌরসভা থেকে বদলী করা অতীব প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয় এলাকাবাসী ।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, আবু জাফর গিফারীর সাথে গভীর সক্ষতা ছিলো ফেনী-২ আসনের বিতর্কিত দূর্নীতিবাজ সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর সাথে ব্যক্তিগত কাজ ও করে দিতেন বলে অভিযোগ আছে আবু জাপর গিফারীর বিরুদ্ধে। নিজাম উদ্দিন হাজারীকে পৌরসভার টাকায় প্রতি বছর রমজান ঈদে সেমাই চিনি বাবদ ১০ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করে দিতেন গিফারী নিজেই। আট(৮) শত বস্তা চাউল দিতো পৌরসভা থেকে যার বাজার মূল্য বিশ লাখ টাকা এমপির জন্য দেয়া হত উপহার হিসেবে বিল করা হতো পৌরসভার নামে। যা এমপি সাহেব নিজের ব্যক্তিগত ফান্ডের কথা বলে বিতরন করতেন এলাকাবাসীর মাঝে ।সুধু তাই নয় এমপির বাড়িতে যত ব্যক্তিগত মেজবান খানা হয় প্যান্ডেল লাইটিং ডেকোরেশন এর খরচ সব পৌরসভার খরচের খাতে তুলে দিতেন তিনি।
পৌরসভার পৌর নির্বাহী একজন কর্মকর্তার এত বিপুল সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকে বলেন, সরকারি কর্মচারীদের একাংশ অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বৈধ আয়ে এত সম্পদ অর্জন সম্ভব নয়।
এই ধরনের দূর্নীতিবাজদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিভাগের বিশ্লেষক প্রফেসর তানবির মাহমুদ বলেন,এমন দূর্নীতিবাজদের দ্রুত আইনের আওতা আনা উচিত এধরনের দূর্নীতিবাজদের প্রকাশ্যে শাস্তি দিলে বাকী দূর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তাগন সচেতন হয়ে যাবেন দূর্নীতি থেকে সরে আসবেন বলে আমি মনে করি ।
আবু জাফর গিফারীর দূর্নীতির বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন তার বিষয়ে আমাদের কাছে বেশ কয়েকটি মৌখিক অভিযোগ এসেছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষ্যে ব্যবস্থা নিবো।
এই বিষয়ে আবু জাফর গিফারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,সরকার আমাকে তিনটি পৌরসভা চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন তার জন্য আমি তিনটি পৌরসভার দায়িত্ব পালন করছি।
অনুসন্ধানীঃ- পর্ব -১